Wednesday, February 12, 2014

স্বর্গের নাম বান্দবন আর তার রাজধানী তিন্দু

কয়েকদিন আগে ঘুরে আসলাম অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই ছোট্ট দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার বান্দরবন থেকে । বাংলার ইবনে ববুতা Rakib Kishore এর একের পর এক লোভ জাগানো ছবি দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে ৫ ফেব্রয়ারী রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু,পরদিন ৬ তারিখ রাত ১১ টায় ঢাকা থেকে উঠলাম বান্দরবনের গাড়িতে ! চেনা অচেনা মিলে আমরা মোট ৯ জন ! ৭ তারিখে সকালে গিয়ে বান্দরবন পৌছেঁ রেস্তোরা তাজিংডং এ সকালের নাস্তা সেরে উঠলাম হোটেল হিলটপে ,দেরি না করে ফ্রেস হয়ে রওনা দিলাম মেঘলায় । পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে আমাদের সাথে পিকনিকের জন্য যোগ দিল "গরীবগ্রুপের" চট্রগ্রামের বন্ধুরা । সবমিলে আমরা তখন ৩৪ জনের এক বিশাল পরিবার, মেঘলা থেকে স্বর্ন মন্দির হয়ে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য ফিরে আসলাম হোটেল হিলটপে ।স্বর্ন মন্দিরটা সত্যিই সুন্দর একটা দেখার জিনিস বটে ।

দুপুরের খাবার খেয়েই চান্দের গাড়িতে চরে চললাম নীলাচলে,নীলাচলটা ভাল লেগেছে কিন্তু আজকাল মানুষ মনে হয় বড্ড বেশি নীলাচলে ঘোরাঘুরির মাধ্যমেই পিকনিক শেষ করে চট্রগ্রামের বন্ধুদের বিদায় দিয়ে আমরা ফিরে আসলাম হোটেলে । কেন জানি সবারই মন একটু খারাপ ছিল হয়ত সারাদিন আর রাতের জার্নির ধকল কিন্তু খাওয়ার পর সাথে যদি থাকে Zonayed Azim Chowdhury এর মত সুকন্ঠের কোন গায়ক তো মন খারাপ আর কতক্ষন ? দোতলার বেলকনিতে গান আর জমপেশ আড্ডায় সবার মন ভাল হয়ে গেল ! এই ফাকেঁ বলে রাখি জুনায়েদ ছেলেটা শুধু ভাল গায় না তার আরও অনেক গুন আছে তবে আমার মনে হয় একটা লাইফ জ্যাকেটকে জলে স্থলে কিভাবে,কত প্রকারে ব্যবহার করা সম্ভব সেটা দুনিয়াতে তার চাইতে ভাল আর কেউ জানে না রাতের ঘুমের সাথে সাথে সকল ক্লান্তি ঝেরে পরদিন সকালেই চান্দের গাড়ি ভাড়া করে ছুটলাম থানচি, উদ্দেশ্য বান্দরবন নামক স্বর্গের রাজধানী তিন্দু !! পথে ঢুঁ মারলাম নীলগিরিতে । সেখানে আমরা অনেক মজা করেছি বিশেষ করে ছবি তুলে





এরপর সোজা থানচির উদ্দেশ্যে রওনা এর মাঝে চিম্বুকে সেরে নিয়েছি হালকা নাস্তা ।

চান্দের গাড়ি ছাড়াও আপনি ইচ্ছা করলে বাসেও যেতে পারেন থানচি তবে খুব বেশি মজা পাবেন না।আবার চান্দের গাড়িতে যাওয়ারও ধরন আছে, ইচ্ছা করলে আরাম করে বসে অপর সীটে বসা যাত্রীর মুখ দেখতে দেখতে যেতে পারেন আবার পিছনে দাড়িয়ে পাহাড়ের বুনো গন্ধ আর খোলা হাওয়া খেতে খেতেও যেতে পারেন, আমি পরেরটাকেই পছন্দ করেছি ! আপনারটা আপনার !! থানচিতে নেমেই কিশোর ভাইদের পরিচিত হোটেলে দুপুরের খাবারটা সেরে নিলাম ।এর ফাকেঁই হাসান ভাই নৌকা আর গাইড ম্যানেজ করে ফেললেন, করে ফেললেন পরের ২ দিনের জন্য কিছু কেনাকাটাও । Hasan ভাই সম্পর্কে বলব তার মত বড় ভাই ট্রিপে থাকলে আপনি উপভোগ করার জন্য যথেষ্ঠ সময় পাবেন, হাসান ভাই থাকলে খাবার বা অন্য কোন ব্যবস্থাপনার জন্য আপনার কোন টেনশন থাকবে না । থানচির পরে আর কোন গাড়ি নেই তাই যাত্রা এবার নৌকায়,গেলে বুঝবেন জল আর পাথরের ফাকেঁ স্রোতের বিরুদ্ধে যেতে যেতে চারপাশের দৃশ্য মনটা সত্যিই উদাস করে দেবে আর ততক্ষনে ভুলে যাবেন মেঘলা,নীলাচল আর নীলগিরিতে আপনি কি দেখেছেন ? চারপাশের দৃশ্য আপনাকে অবাক করে ভাবাবে পৃথিবীর সবচাইতে সবুজের দেশ আমার বাংলাদেশ এত সুন্দর !!!পাথরকে ফাকিঁ দিয়ে নৌকা চলেছে তিন্দুর উদ্দেশ্যে পাথরের সাথে ঘষাও খাচ্ছে আবার মাঝে মাঝে আটকেও যাচ্ছে ,তখন পানিতে নেমে নৌকা ঠেলতে হচ্ছে কিন্তু সেটাও যেন আর এক আনন্দ !!!



 তিন্দুতে নেমেই উঠলাম হোটেল আবাসিক এ ওয়ানে ! তিনতলা হোটেলে আমরা ২ তলায় ৩ টা আর ৩ তলায় ১ টা সুই্যট নিলাম, পুরা হোটেলই কাঠের তৈরি চৌকি থাকলেও মেঝেতে ঘুমানোতেই মজা বেশি ইতিমধ্যে পাশের দোকানেই খাবার দাবারে আয়োজন সেরে ফেলেছেন হাসান ভাই আর কিশোর ভাই । রাতের খাবার তৈরি হতে হতে চলল বারবিকিউ এর প্রস্তুতি ! এখানে হাসান ভাই বস আমি শুধু তার সহযোগী কাজের ফাকেঁ ফাকেঁই চলছে SSweet Pain ওরফে আরমান ভাইয়ের খুনসুটি তার সম্পর্কে বলব আরমান ভাই সাথে থাকলে আপনার যে কোন ট্রিপ ভাল লাগতে বাধ্য ! যে কোন কিছু নিয়েই মজা করার অসাধারন একটা ক্ষমতা আছে তার ।তিনি সাথে থাকলে আপনি চাইলেও মন খারাপ করে থাকতে পারবেন না । রাতের খাবার সেরে আবার ফিরে আসলাম বারবিকিউ এর স্থানে। ইতিমধ্যে আমাদের গাইড সেলিম সাহেব আগুনের কয়লা তৈরি করে ফেলেছেন । আড্ডার সাথে সাথে চলল বারবিকিউ তৈরি ।
অসাধারন একটা পরিবেশ !! আপনার মনে হতে বাধ্য চাদেঁর আলোয় সাঙ্গুর তীরে পাথরের উপর বসে বারবিকিউ ‍চিবুতে না পারলে সত্যি জীবনটাই বৃথা !! বারবিকিউ পার্টি সেরে হোটেলে ফিরে রাতের মত ক্ষান্তি ।পরদিন সকালে উঠে নাস্তা সেরে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাত্রা করলাম রাজা পাথরের উদ্দেশ্যে,একদল যাবে নৌকায় আর একদল ট্রেকিং করে । ট্রেকারদের দলই ভারী হল আমার মোট ৫ জন্য ট্রেকিং এ আর ৪ জন নৌকায় । পাহাড়,পাথর আর নদীর খরস্রোত পেরিয়ে চলেছি তিন্দুর গভীরে। যাত্রপথটা যতটা কঠিন ততটাই মজার !! যাত্রাপথেই আমরা মজা করে খেলাম পাহাড়ি মিষ্টিআলু ,বাদাম আর কলা,নৌকার বন্ধুদের জন্যও সাথে করে নিতে ভুললাম না ।

 রাজা পাথরের পাশে গিয়ে মুখ হাঁ হয়ে গেল প্রকৃতি এত সুন্দর হতে পারে সেখানে সাঙ্গুর ছলছল পানিতে গোসল সেরে সকল ক্লান্তি ঝেরে পাহাড়ি এক পরিবারের আয়োজনে দুপুরের খাবারটা সেরে ফেললাম,চারপাশের পরিবেশ আপনাকে এতটাই আভিভুত করে দিবে যে পাহাড়িদের হাতের রান্নাটাও মনে হবে কোন ফাইভ ষ্টার এর খাবার । খাবার সেরে প্রকৃতির কোলে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে যাত্রা এবার ফিরতি পথে ,স্রোতের অনুকুলে তাই ৯ জন উঠলেও ফিরতে কোন সমস্যা হচ্ছিল না । ফেরার পথে নদীর দুই তীরের উচুঁ উচূঁ পাহাড় আর চারপাশের নিশ্চুপ পরিবেশ আপনাকে দিবে অন্য রকম একটা ভাল লাগা !! নিঃশব্দ পরিবেশে চারপাশের বড় বড় পাথর ,পাহাড় আর সাঙ্গুর তীরের সবুজের মাঝে চলতে চলতে হঠাৎ অচেনা কোন পাখির ডাক কি যে এক মনভোলানো অনুভুতি ! না গেলে সেটা বোঝা সম্ভব নয় ।



সন্ধ্যার আগেই ফিরলাম তিন্দুর সেই হোটেলে । রাত হল ,রাতের খাওয়া হল কিন্তু ঘুমানো আর হয় না ,মনের মধ্যে লেগে আছে শুধু সারাদিনের ভাললাগা !! যান্ত্রিকতার যুগে নেটওয়ার্ক বিহীন একটা জায়গায় এতটা সময় পার করলেও একবারও মনে পড়েনি ফেলে যাওয়া অতি চেনা পরিবেশের কথা। তিন্দুর প্রকৃতি এমনই যে,সে তার সৌন্দর্য দিয়ে আপনাকে ভুলিয়ে দিবে জীবনের সকল দুঃখ কষ্ট গুলোকে,ফিরিয়ে দিবে আপনার শৈশব,ভালবাসতে শেখাবে প্রকৃতিকে আর আপনি নতুন করে আবিস্কার করবেন নিজেকে,নিজের দেশকে । পরদিন ১১ টায় ২ টা নৌকা করে ফিরতি যাত্রায় বান্দরবন ফিরলাম ৩ টা দিকে। ঢাকার গাড়ি রাত ৯.২০ এ তাই সময়টা নীলাচলে কাটানোর সিদ্ধান্ত হল আবার চান্দের গাড়িতে করে নীলাচল পৌছঁতে পৌছঁতে সন্ধ্যা ৬ টা। লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে নীর্জন পরিবেশে কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা ৯ জন আর কেয়ারটেকার ছাড়া নীলাচল একেবারে ফাকাঁ! এবারে আবিস্কার করলাম নীলাচল এর আর এক রুপ ! হাজার ফুট উপরে ঠান্ডা হিম বাতাস মনটাকেও হিম করে দেয়,আনমনা মনে উকিঁ দেয় অতীত আর ভবিষৎ এর নানা ছবি আর নীচে বান্দরবন শহরের বাতিগুলো যেন উদোম হাওয়ায় দেখা স্বপ্নটাকে দেয় আরও পরিপূর্নতা । ছেড়ে আসতে মন চাইছিলনা কারই কিন্তু তারপরও প্রকৃতি ছেড়ে আসতে হল যান্ত্রিক এই জীবনে !! ফিরে এলাম ঢাকা হয়ে লালমনিরহাটে। অসাধারন এই ট্রিপটার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি ‍এই ট্রিপের বাকি ৮ জনকেই এমন সুন্দর কিছু সময় দেয়ার জন্য বিশেষ করে Fahad ভাই্ আর Bappyতো অন্যরকম আর শাহেদ খানেঁর মত ওয়াও ছাড়া ট্রিপটা এত জমতো না কোনমতেই !!


প্রকৃতি আর বান্দরবনের প্রতি আমার ভাললাগাটা আগে থেকেই ছিল কিন্তু এখন সেটা পুরাই প্রেমে পরিনত হয়ে গেল ....