গতকাল সকালে উঠেই মনে হইলো মাথা ন্যাড়া করে ফেলবো, যেই ভাবা সেই কাজ ! সেলুনের ছেলেটাকে ডেকে এনে মাথা ন্যাড়া করে ফেললাম। শুধু ন্যাড়া করেই ক্ষ্যান্ত হই নাই সেটা ফেসবুকেও আপলোড করে দিছি। এই নিয়ে কেউ খুশি আবার অনেকেই নাখোস। একজন তো আমাকে বলে বসেছেন-শিক্ষক মানুষ মাথা ন্যাড়া করা কি ঠিক ? ছাত্র ছাত্রী দেখলে কি মনে করবে ?
মাথা ন্যাড়া্ করাটা দোষের কি বুঝলাম না ! পরে ভেবে দেখলাম দোষ আসলে আমারও না, সেই ব্যক্তিরও না। ছোট বেলা থেকেই আমরা জেনে এসেছি- চুল ঘন ও কালো করা্র চেষ্টা ছাড়া,কোন দোষ করলে শাস্তি স্বরুপ ধরে মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয় । এমন কি মাথা ন্যাড়া করলে শুনতে হত নানা টিপ্পনী। সহপাঠীরা বলতো –
‘ঠুল্লা মাথা
বেল বেল
পইড়া গেল মাথার তেল।’
কারনটাও অবশ্য অনুমেয় কারন ছোট বেলায় মা, দাদীরা ন্যাড়া মাথায় জবজব করে তেল দিয়ে দিতেন ।
কিন্তু মাথা ন্যাড়া কি শুধূ কেশ ঘন কালো আর দোষ করলে শাস্তি স্বরুপ করা হয় ?
জন্মের পরপরই ৭ দিনের মধ্যে মাথা কামানো দিয়ে শুরু হয় ন্যাড়া করার পালা, জন্মানোর পরপরই নিশ্চই কেউ দোষ করে না তাই নিশ্চিত অন্য কোন এক অজানা কারনে মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয় ।
হিন্দু ধর্মে মা বাবা মারা গেলে শ্রাদ্ধের সময় মাথা ন্যাড়া করার রেওয়াজ রয়েছে। আবার এই ধর্মের সদ্য বিধবারাও স্বামীর মৃত্যু শোকে মাথা ন্যাড়া করে থাকেন। অর্থাৎ ন্যাড়া মাথা শোকের আমেজ বহন করে এবং সেটা ধর্মীয় মতে । আবার তীর্থযাত্রীরা মহিলা পুরুষরাও গয়া কাশি বৃন্দাবন ঘুরে আসলে মাথা ন্যাড়া করেন,এটা হয়তো পবিত্রতার স্বরুপ করে থাকেন ।
ইসলাম ধর্মেও পুরুষরা হজ্বের সময় মাথা ন্যাড়া করেন । মানে এখানেও মাথা ন্যাড়া করার সাথে ধর্মীয় সম্পর্ক বিদ্যমান ।
বৌদ্ধ ধর্মের মন্ক বা সন্যাসীদের কথা ভাবলেই প্রথমেই আসে ন্যাড়া মাথা -এখানেও ধর্মের সাথে ন্যাড়া মাথা জড়িয়ে গেছে ।
অর্থাৎ মাথা ন্যাড়া শুধু দোষের কারনে নয় ধর্মও বিভিন্ন কারনে মাথা ন্যাড়াকে সমর্থন দিয়েছে ।
আবার যুগে যুগে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও মাথা ন্যাড়া করা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে । ফিলিপায়েন্সের মানিলা তে চব্বিশ জন শ্রমিক, তাদেরকে ছাঁটাই করার প্রতিবাদে মাথা ন্যাড়া করে প্রতিবাদ শুরু করে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে চীনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের লিঙ্গ বৈষম্যের নীতির বিরুদ্ধে ৪ জন মেয়ে মাথা ন্যাড়া করে প্রতিবাদ করে। এভাবেই যুগে যুগে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে কাজ করেছে ন্যাড়া মাথা ।
এতো গেলো ন্যাড়া মাথার ধর্মীয় আর সামাজিক দিক,চলেন দেখি বৈজ্ঞানিক ভাবে কি ব্যাখা দেয়া হয়েছে - সোশ্যাল সাইকোলজি অ্যান্ড পারসোনালিটি সায়েন্স জার্নালে আমেরিকার পেনসিলভিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হোয়ারটন স্কুলের অধ্যাপক আলবার্ট ম্যানিস দীর্ঘ গবেষনা করে জানিয়েছেন- চুল কামিয়ে চকচকে ন্যাড়া মাথার মানুষরা সচারচর ক্ষুরধার ও কঠিন স্বভাবের। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে তাদের প্রভাবশালী ও বেশি পৌরুষ বিরাজ করে।
এতো গেলো ন্যড়া মাথার স্বপক্ষে যুক্তি । এবার চলুন চিনে আসি ন্যাড়া মাথার বিখ্যাত কিছু ব্যক্তিকে ।
মহাত্মা গান্ধীকে কে না চিনেন, দেশ সেবার আজীবন ব্রত নিয়ে অহিংসবাদী এই মহান নেতা আজীবন ছিলেন ন্যাড়া মাথায় । তিব্বতীয়ান নেতা ও ধর্মীয় গুরু দালাই লামাও ন্যাড়া মাথার মানুষ ।
খেলার জগতেও ন্যাড়া মাথার জয় জয়কার । ন্যাড়া ফুটবলারের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না তার মধ্যে প্রথমেই মনে পড়বে “দ্য ফেনোমেনন” নামে খ্যাত রোনাল্ডোর কথা । ন্যাড়া মাথাকে ব্রান্ডিং করার জন্য রোনাল্ডোর নামটা উপরের দিকেই থাকবে । এরপর যদি কারও চকচকে মাথার কথা মমে পড়ে তো সেটা জিনেদিনে জিদান , অবশ্য এক সময়ের ফ্রান্সের গোলকিপার ফাবিয়ান বার্থেজও ন্যাড়া মাথার জন্য পরিচিতি লাভ করেছিলেন ।
বাস্কেট বলে ন্যাড়া মাথার অভাব নেই তবে বিখ্যাত নামটা অবশ্যই মাইকেল জর্ডান ,টেনিসে যেমন আছেন আন্দ্রে আগাসী । এদিকে অ্যাথলেটিকসে ব্রিটেনের মো ফারাহ তো চার বারের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন।
বক্সিং এর বিখ্যাত দুটি নাম মাইক টাইসন এবং ফ্লয়েড মেডওয়েদার- কাকতালীয়ভাবে দুজনেই ন্যাড়া মাথার ।
ডোয়াইন জনসন কে চিনেন তো ? অবশ্য এই নামে না চেনারই কথা কারন উনি “দ্যা রক” নামেই আমাদের সবার কাছে পরিচিত- নিশ্চই তার ন্যাড়া মাথার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে না । রেসলিং জগতের আরও একজন ট্রেড মার্ক ন্যাড়া মাথার মালিক হচ্ছেন স্টিভ অষ্টিন ।
সিনেমা জগতেও ন্যাড়া মাথার মানুষের অভাব নেই –আমার প্রিয় অ্যাকশন হিরো জেসন স্ট্যাথাম, ট্রিপল এক্স বা ফার্স্ট এন্ড ফিউরিয়াস খ্যাত ভিন ডিজেল, ব্রুস উইলিস, শক্তিশালী ব্রিটিশ অভিনেতা পেট্রিক স্ট্রুয়ার্ট প্রত্যেকেই ন্যাড়া মাথার ।
বিশ্বকাপ ফুটবল দেখলে পিট বুলকেও চেনার কথা – ওই যে, ন্যাড়া মাথার যে মানুষটা ব্রাজিল বিশ্বকাপে সুন্দরি জেনিফার লোপেজের পাশে দাড়িঁয়ে “ওলে ওলা” গেয়েছিল ।
অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা ন্যাড়া মাথার জেফ বেজোস যে, একজন সফল ব্যবসায়ী সেটা ও বলার অপেক্ষা রাখ না ।
মাথা ন্যাড়া করার ক্ষেত্রে নারীরা ও পিছিয়ে নেই –সিনেমা প্রেমী হন আর না হন মিডিয়ায় সামান্য আগ্রহ থাকলেও পাশের দেশের ঋতুপর্ন ঘোষের নাম শোনারই কথা, গুনী এই অভিনেত্রী এবং পরিচালক সব সময়ই ন্যাড়া মাথায় থাকেন । ন্যাড়া করেছিলেন ম্যাড ম্যাক্সের হেরোইন চার্লিস থেরন আবার ধরেন আমেরিকান আইডল কেলি পিকল- যিনি স্তন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়তে থাকা তার বাল্য বান্ধবীকে সমর্থন জানাতে মাথা ন্যাড়া করেছিলেন ।
ন্যাড়ার সাতকাহনের পর ন্যাড়া মাথার সমর্থনে আশা করি আর কিছু বলতে হবে না । এবং ভবিষ্যতে কারও মন চাইলেই বা প্রয়োজনে মাথা ন্যাড়া করতেও দ্বিধা করবেন না ।
কথিত আছে, ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায় – এটাও ভুল ! কারন মাথায় বেল না পড়া পরযন্ত ন্যাড়া বেল তলায় একবার না, যাবেন বারবার :)
No comments:
Post a Comment